আধুনিক যুগের ব্যাংকব্যবস্থা

আধুনিক যুগের ব্যাংকব্যবস্থা

  আধুনিক যুগের ব্যাংকব্যবস্থা:

প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত মাত্রায় কিছু কিছু ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পাদন করলেও আধুনিক ব্যাংকের গঠন, আকৃতি, প্রকৃতি এবং কার্যক্ষেত্রের দিক দিয়ে সেগুলো ছিল ভিন্ন ধরনের। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংক বলতে যা বুঝায় তা এই যুগে নির্ধারিত হয়েছিল। আধুনিক যুগের ব্যাংকব্যবস্থা কে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

১. শ্রমনির্ভর ব্যাংকব্যবস্থা ২. ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নির্ভর ব্যাংকব্যবস্থা ৩. মনুষ্যবিহীন ব্যাংকব্যবস্থা ৪. অনলাইন ব্যাংকব্যবস্থা।

১. শ্রমনির্ভর ব্যাংকব্যবস্থা: ব্যাংকের লেনদেন যখন যন্ত্রপাতি দ্বারা না হয়ে মানুষ দ্বারা সম্পন্ন হয় তখন তাকে শ্রমনির্ভর ব্যাংকব্যবস্থা বলা যায়। শ্রমনির্ভর ব্যাংকিং এর পথিকৃৎ কিছু বিখ্যাত ব্যাংকের কথা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১. ১৪০১ সালে ইতালিতে ব্যাংক অফ বার্সেলোনা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ ব্যাংককেই সর্বপ্রথম আধুনিক ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

২. ১৪০৭ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ব্যাংক অব জেনেভা স্থাপিত হয়।

৩. ১৪০৯ সালে নেদারল্যান্ডের আমস্টার্ডামে ব্যাংক অব আমস্টার্ডাম প্রতিষ্ঠিত হয়।

৪. ১৬৬৫ সালে পৃথিবীর প্রথম সনদপ্রাপ্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যাংক অব সুইডেন প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

৫. ১৬৬৯ সালে মি. উইলিয়াম পিটারসনের সুপারিশক্রমে; ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৬৯৪ সালে এ ব্যাংক গ্রেট বৃটেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে রূপান্তরিত হয়। এটি পৃথিবীর প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

৬. ১৭০০ সালে ভারত উপমহাদেশে প্রথম আধুনিক বাণিজ্যিক ব্যাংক; হিন্দুস্তান ব্যাংক কলিকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে আধুনিক ব্যাংক বিস্তৃত হতে থাকে। 

২. ইলেক্ট্রনিক্স ব্যাংকব্যবস্থা: বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ব্যাংকিং জগতে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয়। প্রথম দিকে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে গাণিতিক শুদ্ধতা নিরূপণের জন্য কম্পিউটার যন্ত্রটির ব্যবহার শুরু হলেও অল্পসময়ের মধ্যে এর কার্যক্রম পাল্টে যেতে আরম্ভ করে। আর্থিক লেনদেনের যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ করার পাশাপাশি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে উন্নত ও দ্রুততর করার কাজে নিয়োজিত করা হয়। ফলে ব্যাংকিং জগতে একটি নতুন ধারার জন্ম হয়। যাকে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং নামে অভিহিত করা হয়।

১৯৬১ সালের দিকে National City of New York সর্বপ্রথম ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নির্ভর পদ্ধতিতে হস্তান্তরযোগ্য লেনদেন চালু করে। যে লেনদেনটি চালু করে তার নাম হলো- Electronic fund Transfer system (EFTS)। এ পদ্ধতির মূল যন্ত্রের নাম  হলো স্বয়ংক্রিয় গণনাকারী যন্ত্র (Automated Taller Machine-ATM). বিক্রয় সেবা বিন্দু টার্মিনাল (Point of Sale-pos Terminals) এবং স্বয়ংক্রিয় নিকাশ ঘর (Automated Clearing House-ACH)। এ ব্যবস্থায় ব্যাংক তার গ্রাহকদের কাগজের ভাউচার প্রদান করতো এবং ভাউচারটি এটিএম মেশিনে ঢুকিয়ে দিলে অর্থ বের হয়ে আসতো তবে ভাউচারটি মেশিনে থেকে যেত।

১৯৬৭ সালের জুন মাসে যুক্তরাজ্যের Barclays Bank প্রথম নগদ বণ্টন বা Cash Dispenser (CD)  স্থাপন করে। এ মেশিনের কার্যপ্রক্রিয়া এটিএম মেশিনের কার্য প্রক্রিয়া হতে পুরোপুরি ভিন্ন ছিল। কাগজের ভাউচার এর পরিবর্তে গ্রাহকদের পাতলা প্লাস্টিক কার্ড সরবরাহ করতো। প্রত্যেক লেনদেনের পর কার্ডটি মেশিনে থেকে যেত। পরবর্তীতে ব্যাংক তার গ্রাহককে কার্ডটি ডাকে পাঠিয়ে দিত যাতে গ্রাহক আবার কার্ডটি ব্যবহার করতে পারে। বার্কলে ব্যাংকের Cash Dispenser চালু করার এক বছর পরে ফ্রান্স, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ডে প্রথম ন্যাশনাল Cash Dispenser চালু করে। ১৯৬৯ সালে জাপান এবং আমেরিকা সিডি মেশিন চালু করে। প্রথম দিকে এ মেশিনগুলো ছিল অফ্লাইন। এ মেশিনগুলো কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত ছিল না।

১৯৭২ সালে গ্রেট বৃটেনের লয়েড্স পূর্বের অফলাইন মেশিন এর পরিবর্তে প্রথম অনলাইন ক্যাশ পয়েন্ট মেশিন স্থাপন করে। তারা তাদের গ্রাহকদের প্লাস্টিক কার্ড সরবরাহ করতো। সেই কার্ডের উপর 'Magnetic Stripe' দেয়া থাকতো। এর ফলে গ্রাহকের হিসাব বা গ্রাহককে শনাক্ত করা যেত। অনলাইন প্রযুক্তিতে প্রতিটি মেশিন ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত থাকত। যদি মেশিন ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত না থাকতো, তবে মেশিন কাজ করতে পারত না। অনলাইন মেশিনে চুম্বকীয় দাগ ম্যাগনেটিক দেয়া প্লাস্টিক কার্ড দিয়ে লেনদেন করার পর মেশিন কার্ডটি না রেখে লেনদেনের পরেই গ্রাহককে ফেরত দিত। বর্তমান মেশিনগুলোতে রঙিন কম্পিউটারের মতো ফুল গ্রাফিক্স স্ক্রিন মনিটর থাকে এবং একই মেশিন থেকে বিভিন্ন মুদ্রার লেনদেন করা যায়। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি উন্নত এবং স্বল্প উন্নত দেশেও এ মেশিন দেখতে পাওয়া যায়। 

৩. মনুষ্যবিহীন ব্যাংকব্যবস্থা: মনুষ্যবিহীন উচ্চপ্রযুক্তি চালিত ব্যাংকিং পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে ভার্চুয়াল ব্যাংকিং ব্যবস্থা নামে পরিচিত। এ ব্যবস্থা অফলাইন ও অনলাইনে ব্যবস্থার চেয়ে আরো উন্নততর। ভার্চুয়াল ব্যাংকিং ব্যবস্থা বলতে আমরা বুঝি, যেখানে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হয় সম্পূর্ণ প্রযুক্তির উপর মানুষ দ্বারা নয় যাকে বলা হয় 'No Man Bank'। 

৪. অনলাইন ব্যাংকব্যবস্থা: আধুনিক ব্যাংকব্যবস্থার আরও উন্নত সংযোজন হলো অনলাইন ব্যাংকব্যবস্থা। আধুনিক বিশ্বের সকল ব্যাংকিংই বর্তমান এ ব্যবস্থার আওতায় আসায় এর গ্রহণযোগ্যতা অনেকগুণ বেড়ে গেছে।


বর্তমান অর্থনীতিতে ‘ব্যাংক’ বলতে এক ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বুঝায়। যেখানে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় সংগ্রহ করে পুঁজি গড়ে তোলা হয় এবং সেই পুঁজি উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়। উদ্যোক্তরা সেই ঋণ গ্রহণ করে সেটা বিনিয়োগ করেন এবং অর্জিত লভ্যাংশ হতে নির্দিষ্ট সময় বা মেয়াদান্তে ঋণকৃত অর্থের উপর সুদ বা মুনাফা প্রদান করে থাকেন। মুনাফার এই টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে সাধারণ সঞ্চয়কারীর হাতে পৌঁছে তার প্রাপ্য লাভ হিসেবে। এভাবেই ব্যাংক বিশ্ব অর্থনীতির প্রধানতম চালিকা শক্তি হিসেবে ভ‚মিকা পালন করে আসছে যুগের পর যুগ।

Previous Post Next Post

Ads