আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকসমূহের ব্যর্থতা

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকসমূহের ব্যর্থতা

১. বিনিয়োগে কাংখিত ইসলামী পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে না পারা : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উনড়বয়নের লক্ষ্যে আমানত সংগ্রহ, পুঁজি গঠন, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সম্পদ আহরণ, মুনাফা অর্জন ইত্যাদি মাপকাঠির বিচারে ইসলামী ব্যাংকসমূহের গড় সাফল্য আশ্বস্ত হওয়ার মত। একইভাবে মূলধন-সম্পদ অনুপাত, তারল্য অনুপাত, মুনাফাযোগ্যতা অনুপাত ইত্যাদি বিচারে ব্যাংকসমূহের অর্জনও নিঃসন্দেহে সন্তোষজক। কিন্তু যে ব্যাপারে ইসলামী ব্যাংকসমূহের ব্যর্থতা এখনো বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে তা হল, ইসলামী ব্যাংকের ঘোষিত লক্ষ্য ও আদশের্র সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন। ইসলামী ব্যাংকগুলো এখনো পর্যন্ত খাঁটি ইসলামী বিনিয়োগ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে পারছে না। খাঁটি ইসলামী বিনিয়োগ পদ্ধতির বাস্তবায়ন প্রশেড়ব ইসলামী ব্যাংকসমূহ এখনো রীতিমত বিব্রত।

বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশে কর্মরত সকল ইসলামী ব্যাংকই মুশারাকা ও মুদারাবার মত খাঁটি ইসলামী পদ্ধতি এড়িয়ে চলে এবং কমবেশী বিতর্কিত অথবা দুর্বল ইসলামী বিনিয়োগ পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। এ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাই মুরাবাহা’, ‘বাই মুয়াজ্জাল’, ‘বাই সালাম’, ‘হায়ার পারচেজ’ ইত্যাদি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিগুলোর সবক’টিতেই মুনাফা পূর্ব নির্ধারিত। অর্থাৎ- ব্যাংক লেনদেনের শুরুতেই মুনাফা নির্ধারণ ও প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে চায়। লোকসানের কোন দায় ব্যাংক বহন করে না। বাই মুয়াজ্জাল ও বাই মুরাবাহা পদ্ধতিদ্বয় বাস্তব ফলাফলের দিক থেকে খুব কাছাকাছি হলেও একটি বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ‘বাই মুরাবাহা’ এর অনুবাদ ‘লাভে বিμয়’ করা হলেও বাই মুয়াজ্জাল অবশ্যই লাভে বিμয় করা হয়ে থাকে। বাই মুরাবাহার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে লাভে বিμয়, নগদ কিংবা বাকী এখানে মূল বিবেচ্য বিষয় নয়। পক্ষান্তরে বাই মুয়াজ্জাল এর মূল কথা হচ্ছে বাকীতে বিμয়; লাভ অথবা ক্ষতি এখানে মূখ্য বিবেচ্য নয়।২ ব্যবসার ক্ষেত্রে বাই মুরাবাহা ও বাই মুয়াজ্জাল প্রভৃতি নিঃসন্দেহে খুবই উত্তম ও মানবিক পদ্ধতি। উদাহরণস্বরূপ গ্রামে-শহরে প্রায়শঃ সীমিত আয়ের মানুষ পাড়ার দোকান থেকে সারা মাস বাকীতে দরকারী পণ্য কেনে এবং মাস শেষে দোকানীর পাওনা পরিশোধ করে। সহজ কথায় এটাকে যদি বাই মুয়াজ্জাল বলা হয় তাহলে এতে দোষের কিছু নেই কিন্তু যখন এই ব্যবসা রীতিকে অর্থায়ন রীতিতে রূপান্তরিত করা হয় তখনই তা প্রশড়ববিদ্ধ হয়ে পড়ে। বিষয়টি আরো ভীষণভাবে প্রশড়ববিদ্ধ হয়ে পড়ে যখন বাই মুরাবাহা ও বাই মুয়াজ্জাল এর মত স্পর্শকাতর পদ্ধতি ব্যবহারের ব্যাপারে শরী‘আহ্ বিশেষজ্ঞদের প্রদত্ত শর্তাবলী সম্পূর্ণ বা আংশিক উপেক্ষা করে এ পদ্ধতি দু’টির যথেচ্ছা ব্যবহার করা হয়। বিশেষকরে প্রকৃত μয়বিμয় সম্পাদনের পরিবর্তে ব্যাংক ম্যানেজার অফিসকক্ষে বসে যখন কেবলমাত্র কাগজপত্র হস্তান্তরের মাধ্যমে μয়-বিμয়ের কাজ সমাধা করেন তখন এই তথাকথিত পদ্ধতির সাথে সুদের পার্থক্য করা দুরূহ হয়ে পড়ে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকসমূহ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ দুর্বলতা কোনভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। বিনিয়োগ কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এমন বিতর্কিত পন্থা অবলম্বন ইসলামী ব্যাংকসমূহের জন্য সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।

২. ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে না পারা: প্রচলিত সুদী ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা যে একটি স্বতন্ত্র ও ভিনড়বধর্মী আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং এ ব্যাংক ব্যবস্থার যে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে, বিগত ৩০ বছরে ইসলামী ব্যাংকসমূহ গ্রাহকদের মাঝে তা যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়নি। ইসলামী ব্যাংকিং-এর প্রসার ঘটা সত্তেও¡ এদেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলামী ব্যাংকিং বলতে কি বুঝায় সে সম্পর্কে এখনো অজ্ঞ। এক্ষেত্রে ব্যর্থতা হল, ইসলামী ব্যাংকিং-এর পরিচয় মানুষের সামনে তুলে ধরার মত প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পনড়ব কর্মী বাহিনী গড়ে তুলতে না পারা। ইসলামী ব্যাংকগুলোতে ব্যাংকিং কার্যμম পরিচালনা করার মত দক্ষ কর্মীর আপাতঃ অভাব মোচন করা গেলেও মাঠ পর্যায়ে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা এবং ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে অপপ্রচারের মোকাবেলায় বুদ্ধিবৃদ্ধিক জবাব দানের মত যোগ্যতাসম্পনড়ব কমীবাহিনী এখনো গড়ে ওঠেনি। সুতরাং ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে অপপ্রচারের মোকাবেলা করা এবং মানুষের ভুল ধারণা দূর করার মত সুদক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে তুলতে না পারা ইসলামী ব্যাংকসমূহের একটি বড় ব্যর্থতা।

৩. ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে গ্রাহকদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে না পারা: প্রতিটি ইসলামী ব্যাংকেই শরী‘আহ্ কাউন্সিল বা বোর্ড রয়েছে। এ শরী‘আহ্ কাউন্সিল বা বোর্ডই সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, কোন্টি ইসলামী ব্যাংকিং পথ বা কোনটি ইসলামী ব্যাংকিং নয়। শরী‘আহ্ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ের জন্য ঝুঁকি গ্রহণে জটিলতা সৃষ্টি করে। ফলে কোনটি ইসলামী পণ্য এবং কোনটি ইসলামী পণ্য নয়, সে ব্যাপারে একটি অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।১ এটি ব্যাংকসমূহের জন্য অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। কারণ ব্যাংকগুলোকে বাজারের গ্রাহকদেরকে এ বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করতে হয়। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, ইসলামী ব্যাংকিং কেবল ব্যাংকের চার দেয়ালের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমগ্র বাজার ব্যবস্থায় এটি বিস্তৃত। যার নিয়ন্ত্রণ অসংখ্য সাধারণ মানুষ তথা গ্রাহকদের হাতে।

৪. ধনিক শ্রেণীর তহবিল সংগ্রহে ব্যর্থতা: আশির দশকের শুরুর দিকে তেল রপ্তানিকারক মুসলিম দেশগুলোতে তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং তেল-বহির্ভুত দেশগুলোতে শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিতে অভাবিত উনড়বতির ঘটনায় মুসলিম দেশগুলোতে একটি ধনিক শেণ্রী গড়ে ওঠে। মুসলিম দেশগুলোর সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে কেন্দ্রী ভতূ হয়ে পড়ে। কিন্তু ধনী মুসলিম ব্যক্তিবর্গ ইসলামী ব্যাংকিং খাতের উনড়বয়নে এগিয়ে আসেননি। তাঁরা তাঁদের বিপুল সম্পদ ইসলামী ব্যাংকে গচ্ছিত রাখার চাইতে প্রচলিত ব্যাংকে গচ্ছিত রাখাকে সবসময় অধিক নিরাপদ মনে করেছেন।২ ইসলামী ব্যাংকসমূহ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ধনীদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়নি। অথচ ধনীদের সহায়তা ছাড়া কোন অর্থিক প্রতিষ্ঠান সহজে প্রতিষ্ঠিত হয় না। বাংলাদেশের অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিনড়ব ইসলামী দাতা সংস্থা এবং গণমানুষের অর্থায়নের ভিত্তিতে এবং এখনো ব্যাংকগুলোর অধিকাংশ শেয়ারের মালিক সাধারণ জনগণ। ইসলামী ব্যাংকসমূহকে আরোও বিকশিত হতে হলে ধনিক শ্রেণীর ব্যাপক আস্থা অর্জন করতে হবে।

৫. প্রকল্প মূল্যায়নে পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ তৈরী করতে না পারা: আর্থসামাজিক উনড়বয়নের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকসমূহের উল্লেখযোগ্য একটি ব্যর্থতা হল, প্রকল্প মূল্যায়নে ইসলামী ব্যাংকগুলোর পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ নেই। প্রকল্পের সম্ভাবনা মূল্যায়নে ব্যর্থতার দরুন লাভজনক প্রকল্প অলাভজনক প্রকল্পে পরিণত হয়। ইসলামী ব্যাংকগুলোকে প্রাথমিকভাবে প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত স্টাফদের ওপর ভরসা করতে হয়। আবার এসব স্টাফকে শরী‘আহ্ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দান করতে হয়। তাই ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রয়োজনীয় স্টাফ শুধু সুশিক্ষিত হলেই হয় না, তাদেরকে ইসলামী ব্যাংকিং-এর তত্ত¡ ও অনুশীলন সম্পর্কে ব্যুৎপত্তিও অর্জন করতে হয়। ইসলামী ব্যাংকসমূহে এ ধরণের স্টাফের প্রচন্ড অভাব রয়েছে এবং এতে ইসলামী ব্যাংকিং-এর সম্ভাব্য প্রসার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।


৬. শরী‘আহ্ রায় ও কাউন্সিলগুলোর মাঝে মতৈক্যের অভাব: শরী‘আহ্ কাউন্সিলের বিভিনড়ব রায়ে ব্যাংকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো খুব সহজেই বিভ্রান্ত হয়। ব্যক্তিগত লেনদেন ও কাগজপত্র কখনো অনুমোদন অথবা কখনো প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং পরে রায় পরিবর্তন করা হয়। এর কারণ হল, বিষয়টি এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে এবং নতুন নতুন পরিস্থিতি ও যুক্তি বেরিয়ে আসছে। এ জন্য রায় পরিবর্তন করা হয়। চুক্তির আওতায় প্রদত্ত সুনির্দিষ্ট অনুমোদন দান প্রশেড়বও প্রায়শ মতপার্থক্য দেখা দেয়। উদাহরণ স্বরূপ : মুরাবাহা চুক্তি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। কিন্তু কয়েকটি শরী‘আহ্ কাউন্সিল চুক্তির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ প্রয়োগ করে, আবার যেখানে লেনদেনের ধারণা ও কাঠামো সহজ এবং অনুমোদনযোগ্য সেখানে লেনদেন কিভাবে পরিচালিত হবে সে ব্যাপারে মতপার্থক্য দেখা দেয়। ফোরাম তৈরী না করতে পারার দরুন রায়দানে এরূপ মতপার্থক্য হচ্ছে। একটি সু-প্রতিষ্ঠিত ফোরাম থাকলে শরী‘আহ্ ‘আলিমগণ ও কাউন্সিল একসাথে বসে যে কোন বিষয়ে মতৈক্যে আসতে পারতেন। শরী‘আহ্ কাউন্সিলগুলোর মধ্যে মতৈক্যের অভাবে ইসলামী ব্যাংকগুলো বিভিনড়ব উদ্যোগ গ্রহণে জটিলতার সম্মুখীন হয়।

৭. তারল্য দলিলপত্রের অভাব: অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংকে ট্রেজারী বিল ও অন্যান্য বিপণনযোগ্য সিকিউরিটির অভাব রয়েছে। যেগুলো তারল্য সংকট মোকাবেলায় ব্যবহার করা যায়। অনেক ইসলামী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আলাদা কার্যμম পদ্ধতি অনুসরণ করায় এ সমস্যা জটিল হচ্ছে। উভয়ের মধ্যে মিল না থাকায় তারল্য সংকট দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ অথবা সমর্থন দিতে পারে না। ইসলামী ব্যাংকিং-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে এ সংকট সমাধান করতে না পারা ইসলামী ব্যাংকসমূহের অন্যতম ব্যর্থতা।

৮. সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও প্রচারের অভাব: অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংকে গ্রাহকদের μমবর্ধমান চাহিদা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় বহুমুখী সামগ্রীর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। একটি পণ্যের গ্রহণযোগ্যতাকে হাল নাগাদকরণ এবং এর প্রয়োগ বহুমুখীকরণে উনড়বত প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের গুরুত্ব বাড়িয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে না। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এ যুগে ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রযুক্তি দ্রæত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না এবং ব্যবস্থাপনা ও নীতি-নির্ধারণী কাঠামো ঢেলে সাজানো হচ্ছে না। সর্বোপরি, কার্যμম পরিচালনায় আধুনিক প্রযুক্তির সংকট রয়েছে। অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংকের গবেষণা ও উনড়বয়নের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও প্রা তিষ্ঠানিক সুযোগ নেই। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক এ যুগে গতিশীল ও আধুনিক কর্মসূচী ছাড়া ইসলামী ব্যাংক টিকতে পারবে না। এ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকগুলো বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে প্রচার মাধ্যমকে উপেক্ষা করে এসেছে, ব্যাংকগুলো তাদের কর্মকান্ড তুলে ধরার জন্য কার্যকরভাবে কখনো প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করেনি। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং প্রচারপ্রচারণায় পিছিয়ে থাকা ইসলামী ব্যাংকসমূহের অন্যতম ব্যর্থতা।

৯. পেশাদার ব্যাংকারের অভাব: ইসলামী ব্যাংকসমূহে পেশাদার ব্যাংকারের অভাব রয়েছে। কোন কোন ব্যাংক মালিক নিজেই ব্যাংক পরিচালনা করেন। অন্যদিকে, অধিকাংশ ব্যাংকই পরিচালনা করে থাকেন ম্যানেজারগণ। এসব ম্যানেজার ইসলামী ব্যাংকিং কর্মকান্ডের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নন। এ জন্য অনেক ইসলামী ব্যাংক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম নয়। ইসলামী ব্যাংকের জন্য অধিকতর মেধা ও দক্ষতাসম্পনড়ব ব্যাংকারের প্রয়োজন। কারণ ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত পেশাজীবিদেরকে সদ্য বিকাশমান পদ্ধতির জন্য নতুন নতুন প্রোডাক্টস উদ্ভাবন করতে হবে। ব্যাংকিং অনুশীলনে পেশাদারিত্বের কোন বিকল্প নেই। তাই ইসলামী ব্যাংক পেশাজীবীদের ইসলামী ব্যাংকিং-এ যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। অধিকাংশ পেশাজীবী পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ওপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

১০. সুষ্ঠু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অভাব: অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ভবিষ্যৎ নীতিমালার পরিকল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সফল পরিকল্পনা মূলত অতীত অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর নির্ভর করে। সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের পটভূমিতে প্রচলিত ব্যাংকিং-এর তুলনায় ইসলামী ব্যাংকিং একটি প্ির তকূল পরিস্থিতিতে রয়েছে। যে কোন অর্থনৈতিক লেনদেনের মূল্যায়নের যথার্থতা নির্ভর করে বিকল্প নিরূপণের ওপর। এ জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তথ্য প্রয়োজন। কিন্তু এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকসমূহের দুর্বলতা রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রতিবছর গ্রাহকদের সামনে গৎবাঁধা পরিকল্পনা উপস্থাপন করে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো।

১১. সামগ্রিক সামাজিক দায়িত্ব পালনে অনগ্রসরতা: মুনাফা অর্জন ইসলামী ব্যাংকসমূহের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। ইসলামী ব্যাংকসমূহকে দারিদ্র্য দূরীকরণ, দাতব্য প্রতিষ্ঠানে অনুদান এবং আয়ের পুনর্বন্টনের মত অত্যাবশ্যকীয় সামাজিক উনড়বয়নে অবদান রাখতে হয়। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. ব্যতীত আথর্- সামাজিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকসমূহের ভূমিকা কাংখিত মানের গতিশীল নয়। ইসলামী ব্যাংকগুলো এখন প্রতিষ্ঠিত ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাই সামাজিক দায়িত্ব পালনে এ খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আরো সম্পদ নিয়োজিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে দু’একটি ইসলামী ব্যাংক ছাড়া অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংকসমূহের ব্যর্থতা রয়েছে।

১২. কৃষি খাতে বিনিয়োগে অপ্রতুলতা: কৃষিখাতে ইসলামী ব্যাংকসমূহের বিনিয়োগ পর্যাপ্ত নয়। এ খাতে ইসলামী ব্যাংকসমূহের বিনিয়োগের বাজার অংশ ৩.৩ শতাংশ মাত্র।১ কৃষি খাতে বিনিয়োগের জন্য কৃষি ব্যাংকের মতো বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে বলে ইসলামী ব্যাংকসমূহের এ খাতে বিনোয়োগে যে অনিহা তা সঠিক নয়। সাধারণত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ খাতে বিনিয়োগ করে না বিধায় ইসলামী ব্যাংকসমূহও করবে না তা মোটেও কাম্য নয়। বস্তুতঃ এমন পথ পন্থা অনুসরণ করলে ইসলামী ব্যাংকসমূহ তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ এখনো কৃষির সাথে জড়িত। তাদের জীবনমান উনড়বত করতে হলে কৃষিতে বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোর পল্লী উনড়বয়ন প্রকল্পসমূহের আওতায় কৃষি বিনিয়োগ বাড়ছে।

১৩. পল্লী শাখা খুলতে না পারা: বাংলাদেশকে বলা হয় একটি বিশাল পল্লী। এদেশের সিংহভাগ মানুষের বসবাস পল্লী এলাকায়। অথচ এ পর্যন্ত দেশে কর্মরত ৭টি ইসলামী ব্যাংকের একটিও পল্লী এলাকায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি।২ একথা ঠিক যে, পল্লী এলাকায় শাখা খুললে শহর এলাকার তুলনায় লাভ কম হয় এবং সে কারণেই প্রচলিত সুদী ব্যাংকসমূহ পল্লী এলাকায় শাখা খুলতে খুব একটা উৎসাহ বোধ করে না। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক তো মুনাফার চেয়ে অর্থনৈতিক উনড়বয়ন ও কল্যাণকে বড় করে দেখে। সুতরাং পল্লী এলাকায় শাখা খুলতে বাধা কোথায়? বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকসমূহের অন্যতম ব্যর্থতা হল এখনো পর্যন্ত দেশের কোথাও একটি পল্লী শাখা চালু করতে না পারা।

Previous Post Next Post

Ads